গোপালের গুরু
গোপালের একবার একটি গুরু হারিয়ে গিয়েছিল। চৈত্রের কাঠ ফাটা রোদ্দুরে বনবাদাড়ে খুঁজে খুঁজে সে বিকেলে নিজের বাড়ির দাওয়ায় ধপাস করে বসে ছেলেকে ডেকে বললে, ও ভাই, জলাদি এক ঘটি জল আনো, তেষ্টায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে। গোপাল হা-হুতাশ করে বলতে থাকে, ভাইরে! আর বুঝি বাঁচি না। ঘরে গোপালের কোন ভাই থাকত না। একমাত্র ছেলে, বৌনিয়ে গোপালের সংসার। গোপালের স্ত্রী রান্নাঘরে ছিল, সে গোপালের কথা শুনে বললে, মিনসের এতটা বয়েস হলো তবু যদি একটু কান্ডজ্ঞান থাকত! নিজের ছেলেকে ভাই বলে ডাকছে গা! ঘরে ছেলে ছাড়া কি আর কটা ভাই আছে গো তোমার! স্ত্রীর কথা শুনে গোপাল বললে, সাধের গুরু হারালে এমনই হয় মা! স্ত্রী মা ডাক শুনে একহাত জিভ বের করে সেখান থেকে পালিয়ে যেন বাঁচে। এ আবার কি কথা?
গোপাল ভাড়ের আলু কেনা
গোপাল ভাড়ের আলু কেনা
1. গোপাল একবার আলু কিনতে টিমার্কে গিয়েছিল। পথে এক বন্ধুর সাথে দেখা হলো। মজার বন্ধু গোপালের আলু কেনার কথা শুনে বলল, বিনি পয়সা দিয়ে আলু কিনতে পারলে দশ টাকা পুরস্কার পাবে। ঠাট্টা করতে করতে গোপালকে উত্যক্ত করেছিল তার বন্ধু। সে ভেবেছিল গোপাল পারবে না।
গোপাল তার বন্ধুকে বলল, এই কথা বললে? তুমি আমার সাথে বাজারে যাবে, আমি টাকা দিয়ে আলু কিনে বাড়ি ফিরব। কাউকে টাকাও দেব না। আপনি আপনার নিজের চোখে এটি দেখতে পারেন।
গোপাল যখন বাজারে গিয়ে প্রত্যেক আলু বিক্রেতাকে জিজ্ঞেস করে, ভাই, আমি যদি আপনার কাছ থেকে পাঁচ সের আলু কিনি, আমাকে কত আলু দেবে? শীতকালে বাজারে প্রচুর আলু আমদানি হয়। আলু চাষিরা বলছেন, পাঁচ সের আলু কিনলে পাঁচ গুণ আলু ফাউ পাবেন। এর বেশি দিতে পারব না। গোপাল তখন প্রতিটি আলু বিক্রেতার ঝুড়ি থেকে পাঁচটি করে আলু নিয়ে বলল, আমি শুধু এই বাজারে ফাউটা কিনেছি, পরের বাজারে আপনাদের সবার কাছ থেকে পাঁচ সের আলু কিনব। সবাই তাকিয়ে দেখল। গোপাল দিব্য বিনি আলু কিনে বাড়ি ফিরে আসে। বন্ধু গোপালকে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দশ টাকা পুরস্কার দিতে বাধ্য হয়। না হলে হয়তো গোপাল একশ টাকা হাতে নিয়ে উড়িয়ে দেবে। তার চেয়ে আগে দেওয়া ভালো
2.গোপাল একবার বিয়ের আয়োজন করেছিল। মেয়েটি খোঁড়া, ছেলেটি খোঁড়া। বর এবং বর উভয়েই বিয়ে করার জন্য গোপালের মুখের কথার উপর নির্ভর করে। কনে জানে না যে বর খোঁড়া, আর কনে জানে না যে মেয়েটি খোঁড়া। গোপারের উগ্র নাম-ডাকের জন্য কেউ কাউকে অবিশ্বাস করতে পারেনি। গোপালের কাছে সব ছেড়ে দিয়েছিল।
বিয়ে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হওয়ার পর বরপক্ষের কর্তা গোপালকে ডেকে বলেন, কনের পক্ষের লোকজন জানতেন না যে বর বিয়ে হয়েছে। বরকে দেখলে কোন বাবা বা মেয়ে অভিশাপ দেবে না। এই জন্য আমরা আপনার কাছে অনেক কৃতজ্ঞ। এ কথা বলে দলগুলো কিছু পুরস্কারের জন্য টাকা দেয়। গোপাল মুখ টিপে শান্তভাবে কিছু না বলে তাদের নিয়ে গেল।
এরই মধ্যে মেয়ের দল চলে এলো। মেয়ের খোঁড়া পাশের লোকজন জানতেই পারেনি, কী বলেন গোপাল! এই বলে কন্যাপক্ষের লোকেরা গোপালকে কিছু পুরস্কার দিল।
উভয় পক্ষের মোটা বাক্স গ্রহণের পর গোপাল হাসিয়া বলিল, আপনি ভদ্রলোক। তাই বলি, তোমার মেয়ে খোঁড়া আর তোমার বর খোঁড়া। তবে এ নিয়ে দুপক্ষেরই ভাবার কোনো কারণ নেই।
গোপালের কথা শুনে বর পক্ষের বুদ্ধি লোপ পায়। তিনি বললেন, আহ, কী বলুন। পাত্রী কি খোঁড়া? তুমি আমাদেরকে আগে বলোনি কেন?
গোপাল বলল, নইলে রাজি হবে কেন? না মানলে আমরাই বদনাম। আমি কারো বদনাম শুনতে রাজি নই। এখন তোমাদের কারোরই কিছু বলার নেই
3. গোপাল ভরের লেখা চিঠি, গোপাল লেখাপড়ার কিছুই জানত না। তিনি সাহিত্য সম্পর্কে কিছু জানলে কিন্তু তার হাতের লেখা খুবই খারাপ ছিল। কিন্তু রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের গোমড়া হিসেবে তার খ্যাতি বহুদূরে ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিবেশীরা তাকে সম্মান করতেন - তাদের মধ্যে কেউ কেউ বিভিন্ন প্রয়োজনে গোপালের সাথে দেখা করতে আসেন এবং পরামর্শ নেন, প্রায় সবাই গোপালের বুদ্ধি অনুসরণ করে। একদিন এক বৃদ্ধা এসে বললেন, গোপাল ভাই, আমাকে চিঠি লিখবেন না। আমার ভাগ্নে পুরী থেকে দশ কোটি দূরে নাগেশ্বরপুরে গেছে। বেশ কিছু দিন হয়ে গেল কোন খবর নেই। গরু পাঠানোর টাকা নেই। বুড়ির কথা শুনে গোপাল বলল, আজ আর চিঠি লিখতে পারব না দাদী। অনেক দিন হয়ে গেল আজ লিখলাম। আর তোমাকে চিঠি লিখতে বলার জন্য সব সময় দেখি না। আজ দেখা হলো, চিঠি লিখো ভাই? আমি একজন বুড়ো মানুষ যাকে চিঠি লিখবো ভাই, তুমিই একমাত্র ভরসা।দাদি আমার পা ব্যাথা করছে।পা ব্যাথার কি হয়েছে? তুমি কি হাতে চিঠি লিখবে? পায়ে হেঁটে চিঠি লিখবে নাকি? তোমার কথা শুনলে আমার হাসি পায়। তোর মতো কথা আমি কখনো শুনিনি। গোপাল হেসে বলল, চিঠিটা হাতে লিখব। কিন্তু আমার চিঠি আর কেউ পড়তে পারবে না। আমাকে আমার লিখিত চিঠি নিজে গিয়ে পড়তে হবে। আমার পা এখন ব্যাথা করছে। এখান থেকে পুরী আর দশ কোটি দূরে পুরী থেকে নাগেশ্বরপুর, আমি চিঠি পোড়াতে পারি না। অন্য কাউকে এভাবে চিঠি লিখতে দাও, দাদি। আমার পা ভালো থাকলে আমি নিজেই চিঠি লিখে পড়ব। বুড়ি মা এর পর আর কি বলবে? বাধ্য হয়ে গোপালের বাড়ি থেকে চিঠি না লিখে ফিরতে হয়।
4. গোলমাল বিজয়ার পরের দিন, গোপাল পথে অন্যদের সাথে আড্ডা দেয়। আড্ডা দিতে গিয়ে গোপাল অন্যের ট্যাক থেকে একটা টাকা নিল আর অন্যটা গোপালের ট্যাক থেকে কিছু বদল করল। সে যখন ছোট টাকা গুনেছে... এক টাকার খুচরা আছে। গোপালের পকেটে একটাই আছে জেনে সে একটু বিষণ্ণ বোধ করল, তারপর গোপাল অপরজনকে বলল, ভাই এসো, আবার আড্ডা দেই। ট্যাকে যা ছিল তা আমি ফিরিয়ে দিই। আমাদের দুজনেরই যে একই পেশা তা এই আড্ডাবাজি দেখে খুব ভালোভাবেই বোঝা গেল। এখন থেকে আমরা বন্ধু।
5. বিবাহ সম্পর্ক
প্রতিবেশীর মেয়ের বিয়ে ঠিক করতে গোপাল এক বাড়িতে যায়। বরের বাবা ছেলেকে ডেকে বললেন, পদ্মলোচন তোমায় দেখতে এসেছে- একবার এসো। সবাই তোমাকে দেখতে চায় বাবা।
বাড়িতে যে ছেলেটি এসেছে তার নাম কনা। গোপাল যখন বরের বাবাকে জিজ্ঞেস করল, এই বরকে বুঝিস? বরের বাবা বললেন হ্যাঁ।
তখন গোপাল বলল, ছেলের নাম পদ্মলোচন? ভালোই রাখলেন। কান টানলেই মাথায় আসে মশাই একবার ছেলের বিরুদ্ধে মহারাজের কাছে নালিশ করে বললেন, তোমার ছেলে তো একটুও লেখাপড়া করে না! পড়ার সময় ঘুরে বেড়ায়। পরবর্তী শিক্ষা নিয়ে চিন্তা করবেন না।
রাজা ছেলেটির উপর খুব রেগে গিয়ে পণ্ডিত মশায়কে বললেন, আবার স্কুলে গেলে কান টেনে নেবে।
মহারাজের কথা শুনে গোপাল তৎক্ষণাৎ বললেন, ঠিকই বলেছ, কান টানলেই মাথা আসে। সবাই হেসে উঠল।
7. দাবা খেলা
গোপাল মাঝে মাঝে বাড়ির দাওয়াতে কারো সাথে দাবা খেলতেন। কেউ প্রায়ই গোপালের সাথে দাবা খেলতে দুই মাইল দূর থেকে হেঁটে যেতেন। অন্তত একটি বাজি খেলতে না পারলে বা কারও সঙ্গে দাবা ম্যাচ হেরে গেলে গোপাল সে রাতে মোটেও ঘুমাতে পারত না। সারারাত বিছানায় শুয়ে শুধু টসটস আর ঘুরছে। দাবার প্রতি গোপালের দারুণ নেশার কথা বলতে গেলে, দাবা খেলতে গিয়ে গোপাল জ্ঞান হারিয়ে ফেলত। একদিন গোপাল দাবা খেলছিল, আর একটা চাল দিলে আর কি?
এমন সময় বাসা থেকে এক ভৃত্য ছুটে এসে খবর দেয়, বাবু দ্রুত বাড়ি চলে যান। কর্তা মাকে সাপে কামড়েছে। কর্তামা খুব কষ্ট পাচ্ছে। ডাক্তার আনতে হবে।
গোপাল দাবা খেলায় মত্ত হয়ে চাকরকে চাল দিতে বলল, কার সাপ? কার নির্দেশে বস মাকে কামড় দিল? সাপের বিরুদ্ধে রাজার দরবারে অভিযোগ করে আমি এখন দৌড়াচ্ছি, যা কিছুক্ষণ পরেই করতে যাচ্ছি।
কর্তাবাবুর কথা শুনে হতভম্ব ভৃত্য দাঁড়িয়ে রইল।
8. গোপাল ও কবি
'বিদ্যাসুন্দর' কাব্যের রচয়িতা কবি ভারতচন্দ্র রাজা কৃষ্ণচন্দ্র। আদি রসের সেবা করার সময় তার সমকক্ষ ছিল না। কৃষ্ণচন্দ্রেরও সহানুভূতিশীল শ্রোতা ছিল, কবি শুনছিলেন বিদ্যাসুন্দর রাজাকে পাঠ করা।
গোপাল রাজসভায় ঢুকে কবিকে কবিতার পাণ্ডুলিপি উলটে পড়তে দেখে চিৎকার করে বললেন, কবি কী করছেন? তোমার কবিতা রসে ভরপুর। কাত করো না বাবা, রস বয়ে যাবে। সোজা রাখুন।
গোপালের কথা শুনে প্রাসাদের সবাই হাসিতে ফেটে পড়ল। এত সুন্দর কথা শুনে কৃষ্ণচন্দ্র তৎক্ষণাৎ গোপালকে তাঁর হৃদয়ের তৃপ্তির জন্য পুরস্কৃত করলেন।
9. গোপাল ও নবাব
এক ভদ্রলোক মুর্শিদাবাদের নবাবের দরবারে চাকরি করতেন। প্রয়োজনে গোপালকে একবার নবাবের দরবারে যেতে হয়েছিল। গোপালকে দেখে ভদ্রলোক পঞ্চাশ টাকা দিয়ে বললেন, দাদা, দয়া করে বাড়ি গিয়ে টাকাটা আমার বউকে চুপচাপ দিয়ে দিন, যাতে আমার বাড়ির আর কেউ না জানে, তাহলে খুব দুর্ভাগ্য হবে।
গোপাল যখন বলল টাকা লুকিয়ে আছে, তুমি নিশ্চিত থাকতে পারো, মশা, একটা কাকও খেয়াল করবে না যে তুমি এই টাকা দিচ্ছো। আসলে, আপনি যাকে টাকা দিতে বলেছেন সেটা সেই ব্যক্তি নয়। মানে, ওই টাকা কাউকে না দিয়ে গোপাল নিজের খেয়াল রাখতে চেয়েছিল।
10. বর গোপাল ভর
গোপাল একবার বর হয়ে বিয়ে বাড়িতে গিয়েছিল। কনের পক্ষের এক বৃদ্ধ জোকার গোপালের সঙ্গে ঠাট্টা করতে উদ্যত হয়ে বলল, গোপাল, তুমিও বর হয়ে এসেছ। আপনি জানেন আমাদের এখানে অনেক বাদর আছে। এখানে বদরের অত্যাচার তীব্র। অবশ্য তোমার চেহারাও বদরের মতো। বলো তো বাদশার মধ্যে কি মানাবে? যদি আগে কেউ বদর না দেখে থাকেন - এই ভ্রমণ আপনাকে বদর দেখতে বাধ্য করবে। আর দেখবেন কথা হবে।
গোপাল তখন কনের পক্ষ থেকে ভদ্রলোককে বললো, এর আগে অনেক বদমাশ দেখেছি কিন্তু তোমার মতো এমন অসভ্য বদমাশ দেখিনি! এবার উপযুক্ত উত্তর পেয়ে ভদ্রলোক একেবারে চুপ হয়ে গেলেন।
11. গোপাল ও মা কালী
একদিন গোপাল পাশা খেলতে গিয়ে দাঁতের ব্যথায় ভুগছিল। একে অসহ্য যন্ত্রণা বলে। যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে তিনি শুয়ে পড়লেন এবং হাহাকার করে বলতে লাগলেন, দোহাই মা কালী! এই যাত্রায় আমার কষ্ট লাঘব করুন...
কিছুক্ষণ পর মা কালীর কৃপায় তার ব্যথা উপশম হয়। মনের আনন্দে সে আবার খুশী মেজাজে পাশা খেলতে থাকে। গোপালের পাশা খেলার সঙ্গী একবার গোপালকে বলেছিল যে তার মায়ের দয়ায় দাঁতের ব্যথা দ্রুত নিরাময় হয়েছে। তুমি কি তোমার মায়ের কাছে একজোড়া পাঠাবে? মনের ইচ্ছা কোরবানি হলে কোরবানির গোশত খাওয়া যায়। গোপাল পাশার ভাত খেয়ে খুশির মেজাজে বলল, আমার ব্যথা তখনই সেরে যেত। এ ব্যাপারে মা কালীর জাদু কোথায়? ব্যথার কথা কি বললাম? মা কালী থাক আমার মনে। তখন গোপাল দিব্যা খোশ মেজাজে পাশা খেলা শুরু করেন। তাদের কথায় পাত্তা দেননি। খেলার সাথী বিরক্ত হল। কিন্তু কথায় আছে- ধর্মের ঘণ্টা বাতাসে চলে। কিছুক্ষণ পর গোপালের দাঁতের ব্যথা আবার অসহনীয় মাত্রায় বেড়ে গেল। এইবার ব্যাথাটা আগের চেয়ে খারাপ। গোপাল যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে মা কালীর দিকে হাত জোড় করে কাঁদতে কাঁদতে বলল- হে মা দয়াময়ী, হে মা দয়াময়ী হে মা জগজ্জননী যে আমি বলেছি... ধরে নিচ্ছি মা? আমি কি সত্যিই বলেছিলাম যে আমি তোমার জন্য এক জোড়া ছাগল কুরবানী করব না? তাই বুঝি মা, জোকস বোঝো না? এবার বলির ভেড়ার মাংস মেরে ফেলা হবে ভেবে খেলার সঙ্গীর মুখে প্রবল হাসি ফুটে উঠল।
Comments
Post a Comment